বিবরণ
বুদ্ধদেব বসু উপন্যাসে মানুষের মনের গল্প বলেন-মনস্তত্ত্বের জট ছাড়ান সূক্ষ বিশ্লেষণে; তার কথায় কখনো ধোঁয়াশা থাকে না, তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্যই হলো প্রাঞ্জলতা। রাত ভরে বৃষ্টি-র দাম্পত্যের জটিলতার ক্ষেত্রেও তা সত্য। বিয়ে ও সংসার নামক যৌথ প্রতিষ্ঠানের জটিল পাকচক্রে আবদ্ধ তিনটি নর-নারীর মনোদৈহিক টানাপোড়েনের গল্প ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’। মধ্যবিত্ত সমাজজীবনে স্বামী-স্ত্রী বা বিবাহিত নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কে ও নানা সুক্ষ জটিলতা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সংশয়ী প্রকাশও বটে। মালতী মুখোপাধ্যায়, নয়নাংশু ও তাদের বন্ধু জয়ন্ত-এখানে শুধুই তিনটি চরিত্র নয়, বরং প্রচলিত যৌন নৈতিকতার প্রথাগত মূল্যবোধের সঙ্গে ক্রমাগত লড়ে চলা মানুষও তারা।১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’র বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনেন আমহার্স্ট স্ট্রীট নিবাসী এক গুন্ডা মার্কা লোক নীলাদ্রি গুহ যিনি ল’ কলেজের ছাত্রও। স্বয়ং লেখক, প্রকাশক ও কলাকুলশীদের লক্ষ করে অভিযোগের তীর ছোড়া হয়। তারাও ছেড়ে না দিয়ে প্রতিহিংসার বিপক্ষে লড়ে যান নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে এই ভেবে নিম্ন আদালত এই বইটিকে নিষিদ্ধ করে দেন। অবশেষে বুদ্ধদেব বসু উচ্চ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ালে বিচারক প্রসন্ন হন। নিম্ন আদালতের রায়টি বাতিল করে তিনি নতুন রায় দেন। এই মামলা চলে প্রায় বছর চারেক ধরে। এই মামলা এক সময়ে এমন পর্যায়ে চলে গেছিলো যে, বুদ্ধদেব বসু তার ছোট মেয়ে দময়ন্তীকে লিখেছিলেন, ‘বইটা আপাতত ‘নিহত’ হবে বলেই ধরে নে।’ পরে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে মুখবন্ধে প্রকাশক জানিয়েছিলেন, ‘এ এমন এক উপন্যাস নিম্ন আদালত যার পাণ্ডুলিপি পর্যন্ত ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছিলেন।’ ১৯৬৯ সালে শুরু হওয়া মামলা শেষ হয় ১৯৭৩-এ অশ্লীলতার অভিযোগ খারিজের মাধ্যমে। মূল বই নিষিদ্ধ হয়েছে জানা মাত্র কলেজ স্ট্রিটের বই বাজার বইটির পাইরেটেড কপিতে ছেয়ে যায়। সাড়া পড়ে যায় বাঙালি পাঠক সমাজে। সবাই হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগে এই বই যার নাম ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি।’ ফলে হু হু করে বেড়ে যায় বইটির বিক্রি।রাত ভ’রে বৃষ্টি’র নায়িকার নিজের জবানবন্দিতে শুরু হয় এই উপন্যাস। “হ’য়ে গেছে-ওটা হ’য়ে গেছে-এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি। করেছি জয়ন্তর সঙ্গে, জয়ন্ত আমাকে চেয়েছে, আমিও তাকে। নয়নাংশু হয়তো ভাবছে আগেই করেছিলুম, কিন্তু না-আজই প্রথম। আজ রাত্রে-চার ঘণ্টা আগে। এই বিছানায়। যেখানে মালতী এখন শুয়ে আছে।”রাত ভ’রে বৃষ্টি শুধু অবৈধ সম্পর্কের কাহিনী নয়। বরং নতুন সময়ের এক ভাঙ্গা দাম্পত্যের করুণ আখ্যান।এই উপন্যাসেই একদিকে নায়ক নয়নাংশুর কণ্ঠে প্রায় প্রবাদপ্রতিম একটি বাংলা বাক্য বলানো হয়েছে: “স্বামী-স্ত্রী, বা স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসাই হলো আসল কথা, ভগবানের চোখে বিয়ে বলে কিছু নেই, দাম্পত্যের নামে লাম্পট্য চলছে ঘরে-ঘরে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা না-থাকলে তাদের একত্র বসবাস গর্হিত, যেখানে মেয়েরা স্বামী আর আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার কোনো সুযোগই পায় না সেখানে তাদের তথাকথিত সতীত্বও একদম ঝুটা মাল।” আবার অন্য দিকে নায়িকা মালতীর কণ্ঠে বলানো হয়েছে একটি কালাতিক্রমী স্বাভিমান বাক্য:”কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যে, বিনা চিন্তায় বিনা ইচ্ছায় বিনা ভালোবাসায় কি স্ত্রীলোকের গর্ভে সন্তান আসে না? আমি এখন বুঝতে পারছি যে সাত সন্তানের মা হ’য়েও কোনো মহিলা কুমারী থেকে যেতে পারেন-হয়তো ঘরে ঘরে এমন গৃহিণী অনেক আছেন যাঁরা একটা বোবা শরীর নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন তিরিশ বছরের বিবাহিত জীবন, আর তা তাঁরা জানেন না পর্যন্ত।”ক্রমান্বয়ে দুটি চরিত্র নয়নাংশু ও মালতী, শোনায় তাদের আত্মকথা। তারা দু’জন শোনায় বিবাহ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধির কথা। একদিকে বিংশ শতাব্দীর উচ্চশিক্ষিত পরিশীলিত রুচিমান বাঙালি যুবার নতুন রোম্যান্টিক প্রেম, রিরংসা থেকে যে নিজেকে ছাড়াতে চায়। গণিকাপল্লীতে যে যায়, কিন্তু সেখানকার আবহে আর গন্ধে যার মধ্যে জেগে ওঠে বিবমিষা। তার রুচিমানতা এই কামার্ত সময়ের কাছে কোথাও আবার ভীরুতা। পাঁচজনের চোখে কাপুরুষ বলেই চিহ্নিত হয়ে থাকে সে। রুচিমানতা আর আধুনিকতার অজুহাতে সে নিজের হয়তো তেমন শিক্ষিত নয় এমন স্ত্রীকে আলাপ করিয়ে দেয় তার বন্ধুমহলে আবার বন্ধুমহলে তাকে অতিক্রম করে তার স্ত্রী-ই ক্রমশ গৃহীত ও মান্য হলে সেই আধুনিক যুবাপুরুষই ঈর্ষান্বিত হন। সন্দেহের আগুনে খাক করে দেন নিজের স্ত্রীকেও। স্ত্রী মালতীর মনও একসময় তাদের সাবেক একান্নবর্তী পরিবারকে মনের মধ্যে হারাতে থাকে আবার স্বামীর বন্ধু সংসর্গে প্রাথমিক আপত্তি থাকলেও, ক্রমশ সেখানে বন্ধুদের কথায় নিজেকে আবার ফিরে পাওয়ার সত্যটিও তো তার কাছে কম মিথ্যে নয়। উপন্যাসের পরিণতিতে নয়নাংশুর মনে হয়, মনের অনেক ব্যবধান তারা মুছে ফেলতে পারতো “যদি অন্তত তোমার আমার শরীরের মধ্যে বন্ধুতা থাকতো! অন্তত কেন বলছি শরীরটাই আসল, চরম সর্বস্ব, ওটাই স্বামী স্ত্রীর নির্ভর-তারই জোরে এমন একটা অসম্ভব আশা করা হয় যে দুজন মানুষ বরাবর একসঙ্গে থাকবে। কিন্তু এর সবথেকে বড় ট্র্যাজেডিটাই হল যে, সেই শরীরটাই যদি না থাকে তাদের মধ্যে? কেমন করে শরীর থাকবে, মন যদি সরে দাঁড়ায়? শরীর-যত জ্বালা এই শরীর নিয়ে অথচ ওটাকে না হলেও চলে না।” শরীর মনের কাহিনীই তো এই উপন্যাস। যদিদং হৃদয়ং তব-কে প্রত্যাখ্যান করতে চাওয়া এমন এক উপন্যাসকে মেনে নেয়নি আপাত শান্ত নিরীহ বঙ্গজীবন। তাই এতে লেগে গেছে অশ্লীলতার তকমা।রাত ভ’রে বৃষ্টি উপন্যাসটি শেষ করার পর প্রথমেই মনে হয়েছে-এখানে অশ্লীলতার তেমন কিছুই ঘটেনি। শুধু বুদ্ধদেব বসুর ব্যতিক্রমী উপস্থাপনের জন্যে নয়, বরং চারিত্রিক দুর্বলতা, নিজস্ব স্বীকারোক্তির অকপটতার জন্যও বটে। এই গল্পটার শেষাংশটুকুতে চরিত্র গুলো যেন নিজেদের সাথেই কথা বলে। এ যেন নিজের সাথেই নিজের দ্বন্দ্বযুদ্ধ। তবুও সবকিছু মিলিয়ে গল্পের ভাবগাম্ভীর্য এতটাই প্রকট যে, শেষ করার পরে একটা ঘোরের মধ্যে পাঠক বুঁদ হয়ে থাকবে।